আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি প্রতিনিধিদের কাছে চান দাসত্ব ও আনুগত্য। আল্লাহ আরও চান তাঁর শৃঙ্খলাবদ্ধ পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে মানুষ সে দায়িত্ব পালন করুক। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এই চাওয়া মানুষের কল্যাণেরই জন্য। পবিত্র কুরআন এ কল্যাণেরই ঘোষণা দিচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে।” (সূরা বাকারা : ২৯) আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলছেন, “নিশ্চয় আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তা শুধু আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য নিয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।” (সূরা লুকমান : ২০)
আল্লাহর সৃষ্টি এ সুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে, পৃথিবীর পরিবেশকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে মানুষের রয়েছে অনেক বড় দায়িত্ব। মানুষের অসচেতনতা ও অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পৃথিবী তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। পৃথিবীকে সুন্দর করার দায়িত্ব মানুষেরই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষই যেন আজ পৃথিবীকে দূষণের দায়িত্ব নিয়েছে! মানবসৃষ্ট নানা কারণে সুন্দর এ পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, গ্রিন হাউজ গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোয়া, ধূলিকণা, ময়লা-আবর্জনা প্রভৃতি।
পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব
পরিবেশ দূষণের প্রভাবে নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবী। বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ বিসুখের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৮ শতাংশ (মোট মৃত্যুর) মানুষ মারা যাচ্ছে। যেখানে বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। ক্যান্সার, হৃদরোগ, এজমা, ক্লোন রেক্টাল, স্নায়ু বৈকল্য, শিশুর মানসিক সমস্যা, হাইপারটেনশন, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, কিডনিজনিত সমস্যাসহ অনেক রোগ দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণে।
নানাবিধ পরিবেশ দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণের ক্ষতির মাত্রা অধিক। আর বায়ুদূষণে বাংলাদেশ গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার এর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে গতবারের মতোই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। অধিক মাত্রার বায়ুদূষণের ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাবও আতঙ্কিত হওয়ার মতো। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮-এর প্র্র্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার। আর পৃথিবীজুড়ে প্র্রতি বছর ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। এ বছর গ্রিনপ্রিস প্রকাশিত একটি প্র্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, প্র্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৮০০ মানুষ মারা যায় যারা বায়ু দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলো। জরিপে আমরা যে সংখ্যা দেখছি তার থেকে অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে; রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এই পরিবেশ দূষণের কারণে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর হলেও রোগে আক্রান্ত হয়েই কেটে যাচ্ছে জীবনের বড় একটা অংশ, নষ্ট হচ্ছে শতশত কর্মঘণ্টা। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত একটি জরিপ বলছে দূষণের কারণে ঢাকার বাসিন্দাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার বছরের সমপরিমাণ সময়। দূষণের ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার আগে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমাদের লড়তে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় আমাদের করণীয়
পরিবেশ দূষণ রোধে সকল নাগরিককে যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা অতীব জরুরি। সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী গড়তে জনসচেতনতা সবার আগে। দেশে পরিবেশ রক্ষায় আইনের কোন অভাব আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজন জনসচেতনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্র্রতিটি পদক্ষেপ হওয়া চাই পরিবেশবান্ধব। পরিবেশ রক্ষায় ব্যক্তি, সামাজিক পর্যায়ে আমরা নিম্নোক্ত প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি-
বৃক্ষরোপণের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ।
বসতবাড়ির আশপাশে ফাঁকা জায়গা, রাস্তার দুইধার, শিক্ষাপ্র্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, খাল-বিলের পাড়, বাঁধ-বেড়িবাঁধ, মসজিদ চত্বরসহ সম্ভাব্য সকল জায়গায় পর্যাপ্ত ফলদ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বৃক্ষ রোপণ না করা।
প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করা। কাঠের বিকল্প ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করা।
রান্নার জ্বালানি হিসেবে খড়ির ব্যবহার কমানো। বিকল্প হিসেবে চারকল, গ্যাস, কয়লা ও ঘুটের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।
উন্নত চুলার ব্যবহার সম্প্র্রসারণ করা প্রয়োজন, যেখানে কম খড়ি প্রয়োজন হয় এবং কম ধোঁয়া নির্গমন হয়।
পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসাবে পাটজাত ও অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করা।
আগাছানাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহার যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি জৈব কৃষির ওপর অধিক জোর দেয়া।
নির্বিচারে বন্য ও জলজ প্রাণী শিকার বন্ধ রাখা।
বন-জঙ্গল, জলাশয়, নদী, সাগর দূষণমুক্ত রাখা।
জলাশয় ভরাট বন্ধ করা।
পরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক বেশি। ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগ ফলপ্রসূ করতেও রাষ্ট্রের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রকেই জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও যথোপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সুন্দর পৃথিবী তৈরির সামগ্রিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সমন্বয়
জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইপিসিসি (বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তঃ সরকার প্যানেল) তাদের গবেষণায় বলেছেন, আমাদের গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যেটা প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও খানিকটা বেশি। এতে আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা ও খাদ্য সঙ্কটের ঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো বেশ ভালোভাবেই স্পষ্ট হচ্ছে। সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় আবহাওয়া পাল্টে গিয়েছে এবং অনেক দ্বীপের অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।
তাপমাত্রার এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এই সময়ে বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর উচিত আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক আচার ব্যবহারের পরিবর্তন আনতে সবাইকে সোচ্চার করা। কেননা জলবায়ু পরিবর্তন কোনো দেশের একক সমস্যা নয়। সব দেশ একসঙ্গে কাজ না করলে এককভাবে কোনো দেশের তা মোকাবেলার সামর্থ্যও নেই। বিশ্বমোড়লদের এই বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা হয়তো আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে।
পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ রোপণের ভূমিকা
বৃক্ষ বা গাছ আল্লাহর অন্যতম সুন্দর সৃষ্টি। সুন্দর পৃথিবীর শোভাবর্ধনে আল্লাহর এই অপরূপ সৃষ্টির ভূমিকা অপরিসীম। গাছ মানুষের পরম বন্ধু। এর নির্মল বাতাস আমাদের দেহ ও মনকে রাখে সুস্থ ও সতেজ। গাছ ও মানুষ একে অপরের সাথে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গাছপালা খাদ্য তৈরির সময় পরিবেশ হতে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে আর সমগ্র মানবকুল বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। একটি বয়স্ক গাছ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ ও ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণ রোধ করে। বৃক্ষরাজি শব্দ দূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। বৃক্ষ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে। রাসূল (সা.) তাঁর উম্মতকে বৃক্ষরোপণ বারবার তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেন যদি কোন মুসলিম বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, মানুষ কিংবা পশু সেই ফসল খায় তা তার জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হয়। (বুখারি-২৩১০, মুসলিম-৪০৫৫) বৃক্ষ রোপণের সাথে পরিচর্যাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় নবীজি (সা.) বৃক্ষের পরিচর্যার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্র্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহপাক তাকে সদকার নেকি দেবেন।’ (মুসনদে আহমদ-১৬৭০২)
আসুন, রাসূল (সা.)-এর তাগিদ উপলব্ধিতে এনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও পৃথিবীকে সুন্দর করতে বেশি বেশি গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করি।
তরুণ যুবকদের দায়িত্ব
পৃথিবী, পরিবেশ, জলবায়ু বাঁচলেই; বাঁচবো আমরা। ফলে হাতে হাত ধরে পৃথিবীকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে তরুণদেরও। পৃথিবী গড়ার কাজে তরুণ সমাজের রয়েছে অনস্বীকার্য অবদান। যুগে যুগে তরুণ-যুবকরা বাধা মাড়িয়ে রক্ত আর ঘামের বিনিময়ে বারবার ছিনিয়ে এনেছে মানবতার বিজয়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে তরুণদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের কথা। দেশের ঐতিহাসিক সব অর্জনে তরুণ-যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আজ তরুণদের পৃথিবীকে বাঁচাতে ভূমিকা পালন করতে হবে। পৃথিবীতে বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি ও সংরক্ষণে তরুণ প্রজন্মকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। মাত্র ১৬ বছর বয়সী ‘গ্রেটা থানবার্গ’ (ডেনমার্কের নাগরিক) এই মুহূর্তে একটি আলোচিত নাম। এই অল্প বয়সেই সে নিজেকে নিয়ে গেছে বিশ্বের পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃত্বে। শত শত মানুষের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছে সে। তাঁর আহ্বানে ১৮৫টি দেশের স্কুলছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছিল। গ্রেটা থানবার্গের আন্দোলন কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে তরুণদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
তরুণরা এক হয়ে কাজ করতে পারলে রুখে দেয়া সম্ভব পরিবেশ দূষণকারী দুষ্টচক্রকে, গড়ে তোলা সম্ভব দূষণমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তরুণরাই পারে সমাজের অসচেতন অংশকে সচেতন করতে। পরিবেশ রক্ষার চেতনাদীপ্ত তরুণদের আজ জেগে উঠতে হবে চড়াই উতরাই মাড়িয়ে; ছিনিয়ে আনতে হবে বিজয়। তা হবে পরিবেশ রক্ষা ও পরিবেশ দূষণ রোধের বিজয়।
মন্তব্য