স্বাধীন দেশের জনগণ আজ ফ্যাসিবাদের হাতে বন্দি। বন্দি এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকাগুলো নিজস্ব জৌলুস হারিয়ে আজ ম্রিয়মাণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টিশীলতার চর্চা আজ ক্ষমতাসীন দল ও তাদের লেজুড়বৃত্তিক পেটোয়া বাহিনী, হেলমেট বাহিনীর হিংস্র ও নির্লজ্জ থাবায় রক্তাক্ত। জাতির ওপর জেঁকে বসেছে ইসলাম ও মানবতার শত্রু এক জগদ্দল পাথর, যারা নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করছে না।
ঘরে ঘরে চাকরি, দশ টাকা সের চাল আর দেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মুলা ঝুলিয়ে, সাধারণ মানুষকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের গালগল্প বলে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছিল তারা। বিগত পনেরোটি বছর ধরে তারা জাতিকে ঘুম পাড়ানো মাসি-পিসির গান গেয়ে ভুলিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের নষ্ট রাজনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে এদেশের যুবসমাজকে। তরুণ-যুবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে গেমস আর টিকটকের মতো নীরব ঘাতক। নেশা আর পর্নোগ্রাফি আজ সমাজের সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্যের নাম। এক গবেষণায় দেখা গেছে- ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ৮৬ শতাংশই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। বেকারত্ব, হতাশা আর নেশার প্রকোপে আত্মহত্যা করছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় তরুণ।
সংবিধানের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ এক গভীর জাতীয় সঙ্কটে নিপতিত করেছে বাংলাদেশকে। হরহামেশাই হরণ করেছে এদেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ে পুলিশকে দিয়ে হামলা চালিয়ে গণতন্ত্রকে করেছে ভূলুণ্ঠিত। বিশেষত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সবধরনের নাগরিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে নির্মমভাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল আইনের অপপ্রয়োগ চলছে অহরহ।
আজ বাতাসে কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যায় হাজারো গুম হওয়া মানুষের স্বজনদের করুণ আর্তনাদ। ব্রিগেডিয়ার আযমী, ব্যারিস্টার আরমান, ওয়ালীউল্লাহ, আল মুকাদ্দাসসহ প্রায় ৬১৪ জন নিরীহ মানুষের হাহাকার আর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে বাংলার আকাশ-বাতাস। নির্বিচারে শেষ করে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য তাজাপ্রাণ। অনুভব করতে পারেন কি শহীদ নোমানী, শহীদ আবরারসহ শাহাদাত বরণকারী ভাইদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসা শেষ কালেমার ধ্বনি?
জাতীয় রাজনীতির অধঃপতনের দরুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সকল স্তরের স্বাভাবিক কর্মবিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে দোকানপাট, খেলার মাঠ, গ্রামের ক্লাবঘর, বাসস্থান; সকল জায়গা আজ মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রায়শই ইভটিজিং এমনকি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে আমাদের মা এবং বোনেরা। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে। টাকা আর ক্ষমতার বিনিময়ে আইন-আদালত নিজের পক্ষে নিয়ে নেওয়া আজ এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা তাদের একেকটি মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করেছে। গণতান্ত্রিক সকল ছাত্রসংগঠনকে দেশের ক্যাম্পাসগুলো থেকে বের করে দিয়ে তারা তাদের একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেছে সেখানে। হত্যা, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অত্যাচার-নির্যাতন আর র্যাগিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিণত করেছে একেকটি ভয়াল জনপদে। এক চরম নিরাপত্তাহীনতার কবলে আজ গোটা বাংলাদেশ।
নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০-এ আমরা যে গণতন্ত্র অর্জন করেছিলাম, বিগত ১৫ বছরের অপশাসনে তার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। দেশের সকল সেক্টর আজ একটি বিশেষ দলের হাতে জিম্মি। সবকিছুর শেকড় রসুনের মতো এক জায়গায় এসে মিলে গেছে। সরকার উন্নয়নের নামে যা করছে, তা সাক্ষাৎ এক উৎপাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জনগণের সামনে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে যে অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির রেকর্ড গড়া হয়েছে, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসেই তা বিরল।
সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে অবিবেচকের মতো চুক্তি করে শত শত কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। বিদ্যুৎ আর ব্যাংক নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীরা যেভাবে দোকান খুলে এই দুই খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে, মধ্যম আয়ের কোনো দেশ এটা চিন্তাও করতে পারে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর রেমিট্যান্সের টাকার যে যত্রতত্র ব্যবহার, তার সাথে বেগমপাড়ার বাড়ি বা প্রাসাদের সম্পর্ক সহজেই বোঝা যায়।
বিগত পনেরো বছরে আওয়ামী সরকার দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। ভোট ডাকাতিকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে তারা! আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরতি করে রাখার মতো নজিরবিহীন ইতিহাস তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। বিদেশে অবস্থানরত নাগরিক এবং এমনকি মৃত ব্যক্তিরা পর্যন্ত ভোট দিয়ে গেছে বিগত নির্বাচনগুলোতে! তাছাড়া বিগত পনেরো বছর ধরে এই জালিম সরকার যে মাস্তান বাহিনী গড়ে তুলেছে, প্রশাসনের ভেতরে যেভাবে নিজস্ব দলীয় কর্মী সেট করেছে; তা বলবৎ রেখে কখনও একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।
অন্যদিকে যারা অবৈধ সরকারের এসব অনাচারের বিরোধিতা করতো, মানুষকে গঠনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের চর্চা করতে হাতে-কলমে শিক্ষা দিত, তাদের জীবন গঠন ও মানবসম্পদে পরিণত হতে সহায়তা করতো, যাদের কথায় হাজারো পথহারা মানুষ মুক্তির দিশা পেতো; সরকার নতুন আইন পাস করে, পেটোয়া বাহিনী দিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে, সাক্ষীদের শিখিয়ে-পড়িয়ে, সাজানো ট্রায়াল করে বিচারকদের পকেটে পুরে সেই সকল সোনার মানুষদের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের অনেককে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করে দিয়েছে। এখনও অনেক দেশপ্রেমিক বর্ষীয়ান রাজনীতিককে বন্দি করে রেখেছে কারাগারে।
ওরা মনে করেছে- ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ফেললেই ইসলামের পতাকা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাবে। ওরা ফুৎকার দিয়ে কুরআনের আলো নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ পাক তাঁর দ্বীনের আলোকে প্রজ্বলিত করবেনই। ওরা যাঁদের শহীদ করে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, তাঁরা আজ কোটি কোটি জনতার প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছেন। অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মাওলানা আবদুস সুবহান, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী, কামারুজ্জামানরা আজ কোটি মানুষের প্রেরণার বাতিঘর। এটা প্রমাণিত হয়েছে- তাঁদের শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এদেশের ইতিহাস জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস, হার না মানার ইতিহাস। এই ভূখন্ডে শাহজালাল, শাহপরাণ, শাহ মখদুম, খান জাহানদের উত্তরসূরিরা আজও বর্তমান। ওরা আমাদের গৌরবময় সেই স্বর্ণ জ্বলজ্বলে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। মুসলমানদের সাফল্যগাথা আর সংগ্রামী ইতিহাস যেন শিশু-কিশোররা জানতে না পারে, অব্যাহতভাবে সেই ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। কিন্তু ফকির আন্দোলন, শরীয়তুল্লাহ-দুদুমিয়ার ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সাইয়েদ আহমদ বেরলভীর মুক্তি সংগ্রামের মতো দুর্বার আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত জনগণই ফ্যাসিবাদের পরাজয় নিশ্চিত করবে ইন শা আল্লাহ।
আজ সময় এসেছে বঞ্চিতদের পক্ষে রাজপথে নেমে দাবি আদায়ের আন্দোলন করার। ইস্পাতকঠিন আন্দোলন গড়ে তুলে ফিরিয়ে আনতে হবে গণতন্ত্রের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, ভোটের অধিকার, মিছিল-মিটিংয়ের অধিকার। বিনাশ করতে হবে হবে সকল বঞ্চনার। আজ জাতির কাণ্ডারি হিসেবে তরুণ সমাজকে মানবতার পক্ষে জেগে উঠতেই হবে। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে সকল ষড়যন্ত্রের মিথ্যে দেওয়াল। জাতির যেকোনো সঙ্কটে-সংগ্রামে ছাত্রশিবির বরাবরই ছিল অগ্রভাগে। অধিকার আদায়, দেশ ও ইসলাম রক্ষার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে ৭ দফা দাবিসমেত রাজপথে নেমেছি আমরা। আমাদের দাবিগুলো হলো-
১. ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
২. আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিঞা গোলাম পরওয়ার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সেলিম উদ্দীন, মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমানসহ সকল আলিম ওলামা, ছাত্রনেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। ছাত্রশিবিরের গুম হওয়া ৫ জন নেতাকর্মীসহ সারাদেশে গুম হওয়া সকলকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সারাদেশের অফিসসমূহ দ্রুত সময়ের মধ্যে খুলে দিতে হবে। সেই সাথে ছাত্রসংগঠন হিসেবে সকল রাজনৈতিক ও ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি নির্বিঘ্নে পালনের সুযোগ দিতে হবে।
৪. দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে সকল ছাত্রসংগঠনের সহ-অবস্থান নিশ্চিত করা ও ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির সুস্থ ধারা চালু করতে হবে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সকল শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসসমূহকে নিরাপদ করতে হবে।
৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাতিল করে নৈতিকতাসমৃদ্ধ, কারিগরি ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে; যেখানে সকল পর্যায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকবে। সেই সাথে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও উন্নত করে আরও যুগোপযোগী করতে হবে।
৬. শিক্ষার সকল পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশুদের অবৈতনিক শিক্ষা দান নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে কাগজ-কলমসহ সকল প্রকার শিক্ষা উপকরণের মূল্য হ্রাস করতে হবে।
৭. দেশের মোট বাজেটের ২৫ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে এবং শিক্ষা বাজেটের এক-চতুর্থাংশ গবেষণায় ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ভ্যাট হ্রাস করতে হবে।
তরুণদের অংশগ্রহণ ছাড়া এদেশে কোনো সংগ্রাম সফল হয়নি। আওয়ামী করাল গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে তাদের ভূমিকা পালনের কোনো বিকল্প নেই। পরিবর্তনের জন্য তাদের জাগতেই হবে আজ। বাংলাদেশকে বাঁচাতে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। আমরা স্বপ্নের জাল বুনে চলি- আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আবারও সারাবিশ্বের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ইনশাআল্লাহ।
মন্তব্য